ইংরেজিতে রায়-আদেশ দেওয়া থেকে সরে আসছেন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা। দিনদিন উচ্চ আদালতে এখন বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। ইতোমধ্যে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ১৪৯টি রায় ও আদেশ বাংলায় এসেছে, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এছাড়া হাইকোর্টের দুজন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায়-আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, একজন বিচারপতিই এ পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি মামলার রায় ও আদেশ লিখেছেন বাংলায়। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালতে আবেদনও এখন বাংলায় করা যাচ্ছে। এদিকে ইংরেজিতে দেওয়া আদালতের রায়গুলো সহজে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য ২০২১ সালে ‘আমার ভাষা’ নামে একটি সফটওয়্যারের উদ্বোধন করা হয়। ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ বছর ১ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটের ‘বাংলা সংস্করণ’ উদ্বোধন করা হয়েছে। উদ্বোধন করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এতে বিচার বিভাগের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উচ্চ আদালতে বাংলায় রায়-আদেশের সংখ্যা বাড়ায় বিচারপ্রার্থীদের বিড়ম্বনা কমেছে বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন। সম্প্রতি তিনি যুগান্তরকে বলেন, অন্তত বিচারপ্রার্থীদের কথা চিন্তা করে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানো উচিত। ইংরেজিতে রায় বা আদেশ হলে সেটা বুঝতে বিচারপ্রার্থীর অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। সেই বিবেচনায় ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় রায়-আদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সুপ্রিমকোর্ট।
তবে এ পর্যন্ত কতগুলো রায়-আদেশ বাংলায় দেওয়া হয়েছে এর কোনো পরিসংখ্যান নেই বলে জানিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পরিসংখ্যানের বিষয়ে পরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের ইংরেজিতে দেওয়া রায় বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে। জনসাধারণের জন্য প্রচার করা হচ্ছে ওয়েবসাইটে।
তবে ব্যবহার বাড়লেও এটা সত্যি, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বাংলা পুরোপুরি উচ্চ আদালতের ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। এখানে বার্ষিক ক্যালেন্ডার ও দৈনন্দিন কার্যতালিকা (কজ লিস্ট) বাংলায় তৈরি করা হলেও বেঞ্চভিত্তিক এ তালিকা ওয়েবসাইটে মেলে ইংরেজিতেই। দাপ্তরিক অনেক কাজ বাংলায় সম্পাদন করা হয়।
কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদে শুনানি হয় ইংরেজিতে। আদালতের বেঞ্চ কর্মকর্তারা মামলার নম্বর ধরে ইংরেজিতে ডাক দেন।
এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ঔপনিবেশিক আমল থেকে আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হয়ে আসছে। এ কারণেই ইংরেজি ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদানে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। এছাড়া আইন বিষয়ে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত বাংলা পরিভাষা ও পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে উচ্চ আদালতে শতভাগ বাংলা ভাষার প্রচলন করার বাস্তবসম্মত অসুবিধা এখনো রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যারটি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। সরকার আদালতসহ রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন করে একুশের চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।
সূত্র জানায়, দায়রা আদালতের রায়ের পর্যালোচনায় যখন হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করেন, তখন ক্ষতিগ্রস্ত বা লাভবান পক্ষ, আসামি বা বাদী যে-ই হোন, তিনি ইংরেজি ভাষার কারণে প্রকাশিত রায় বুঝতে পারেন না। জানতে পারেন না কী কারণে এবং কীসের ভিত্তিতে তার দণ্ডাদেশ বহাল থাকল বা খালাস হলো।
সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন বিষয়ে এবং বেতার ও টেলিভিশনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ এবং দূষণ রোধে হাইকোর্টের রুলসহ নির্দেশনা রয়েছে। দুটি নির্দেশনাই এসেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। একটি ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, অন্যটি ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। একটির ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, অন্যটিতে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় আদেশ দেন হাইকোর্টের পৃথক দুটি বেঞ্চ। কিন্তু এর বাস্তবায়নও এখনো কার্যত হয়নি।
সূত্র জানায়, বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে ১০০ বিচারপতি আছেন। বছর দশেক আগেও বাংলায় রায়-আদেশ দেওয়ার সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বিচারপতিদের যারা বাংলায় রায় লিখেন, তারা তা লিখছেন মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার টানে। বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন তারা।
গত বছর আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। দেশের ইতিহাসে এ মামলার আসামির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর রায়ের পৃষ্ঠার সংখ্যার দিক থেকেও এটি সবচেয়ে বড় রায়। সেই রায়ের ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠা বাংলায় লিখে আলোচনায় এসেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। ওই রায়ের অনুলিপি সংরক্ষণের জন্য বাংলা একাডেমিতে হস্তান্তর করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান বেশির ভাগ রায়, আদেশ ও নির্দেশ বাংলায় দিচ্ছেন। ১৫ হাজারের বেশি রায় বা আদেশ বাংলায় দিয়েছেন তারা। গত বছর ভাষার মাসে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া শুরু করেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ। ওই বছর ভাষার মাসে তিনি বিভিন্ন মামলায় ১ হাজার ১৭৫টি রায় এবং ৬৩৭টি আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। এ বেঞ্চ আলোচিত গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ও দিয়েছেন বাংলায়।
হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন যোগদানের পর নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি মামলার রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন এ বিচারপতি। তিনি বলেন, ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল থেকে বাংলায় রায়-আদেশ দিয়ে যাচ্ছি। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন তিনি।
বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল নিয়মিত বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন। এর আগে বাংলায় রায় লিখেছেন বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি এআরএস আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি একে বদরুল হক, বিচারপতি ফজলুল করিম, বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি মো. আবদুল কুদ্দুস, বিচারপতি এসএম জিয়াউল করিম, বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদিন, বিচারপতি মো. হাসান আমীম, বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন প্রমুখ।
সুপ্রিমকোর্টে প্রায় ১০ হাজার আইনজীবীর মধ্যে মাত্র দুজন-মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও আবু ইয়াহিয়া দুলাল উচ্চ আদালতে বাংলায় মামলা দায়ের ও শুনানি করছেন। যদিও তারা আদালতের রায় বা আদেশের কপি পান ইংরেজিতে